প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ

712

॥ আনোয়ার আল হক ॥

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বহুবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে আমাদের এই প্রিয় দেশটি। প্রাণহানিও হয়েছে অনেক; তবে দুর্যোগ মোকাবেলা করে ঘুরেও দাঁড়িয়েছে মানুষ।

এই তো গতমাসেই চট্টগ্রামসহ পার্বত্য তিনজেলায় আকস্মিক পাহাড় ধসের কবলে পড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটি জেলাতেই মারা গেছে ১২০ জন। তবে পাহাড় ধসও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও এটি একটি আঞ্চলিক সমস্যা। কিন্তু অন্যান্য দুর্যোগগুলো আমাদের ভিত কাপিয়ে দিচ্ছে। বন্যা জলোচ্ছাস তো আছেই- আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার পর অন্যতম টর্নেডোপ্রবণ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।

প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগের সাথেই বাংলাদেশের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষ করে বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় বিশাল এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এখন একথা সর্বজন বিদীত যে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে উপকূলের মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছে। অসময়ের বন্যা, খরা ফসলের ক্ষতি করছে। সর্বপোরী লবণাক্ত পানি চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি আশঙ্কা জনক পর্যায়ের দিকে এগুচ্ছে। কিছুদিন আগে হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেট এলাকায় যে বন্যা দেখা দিয়েছে তা দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চল প্লাবনে তলিয়ে গেছে।

আমাদের এই দেশে প্রায় প্রতি বছরই কম বেশি বন্যা হয়। তবে মাঝে মাঝে বন্যা স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে ভয়াবহ আকার ধারন করে। তখনই বন্যা আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবার বড় ধরনের বন্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দেশের জনগণের জীবন-জীবিকা, সহায়-সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদসহ পরিবেশের বিপুল ক্ষতিসাধন করে এই বন্যা। অনেক সময় জাতীয় দূর্যোগ ঘোষণা করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করা হয়, যা দেশের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত করে।

তবে আশার কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে নজির সৃষ্টি করেছে। বিশেষত: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজ উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করছেন এবং সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সদ্য পাশ হওয়া বাজেটেও দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ বিশেষ প্রস্তুতি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বলেছেন, দুর্গত এলাকার মানুষের পুনর্বাসনে সরকার সকল ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১০০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ২২০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। ভবিষ্যতে আরও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
এর আগে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন এমপির প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতার

জন্য ১২টি স্মল মেরিন রেসকিউ বোট, ৪টি একুয়াটিক সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ বোট এবং ১৩টি উদ্ধার মোটরযান কেনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগাম সতর্কবার্তা পাঠানোর জন্য মেগাসাইরেন ফোন এবং স্যাটেলাইট মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। আপদকালীন সময়ে মানবিক সহায়তা হিসেবে শুকনো খাবার, জিআর চাল, জিআর ক্যাশ, চাল, ঢেউটিন, কম্বল ও সাময়িক আশ্রয়ের জন্য তাবু বরাদ্দ দেয়ার জন্য মজুদ রাখা হয়েছে।
শেখ হাসিনা এসময় আরো বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ নির্মাণ অথবা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি জানান, জুলাই ২০০৯ হতে জুন ২০১৬ পর্যন্ত ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রায় এক হাজার ১৫০ কিলোমিটার বাঁধ পুনঃনির্মাণ/পুনরাকৃতিকরণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, উপকূলবর্তী খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা,পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর জেলায় ১৭টি পোল্ডারকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা উপযোগী করে বাঁধগুলোকে মজবুত ও উচ্চতা বৃদ্ধি করার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসময় তিনি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন পদক্ষেপ বিস্তারিত তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের সেবার জন্যই আমরা রাজনীতি করি। শুধু সরকারি দলে থাকলেই নয়, বিরোধী দলে থাকতেও আমরা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকার মানুষের সহযোগিতায় সরকারিভাবে এবং দলীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কয়েকটি টিম গঠন করা হয়েছে। ঝড় আসলে কি কি করণীয়, এ ব্যাপারে একটি বই ছাপানো হয়েছে। বইটিতে স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয়ভাবে কি করণীয় এ ব্যাপারে সব ধরনের গাইড লাইন দেয়া রয়েছে’।

একথা আজ দেশবাসী কারোই অজানা নয় যে, দেশের মানুষের চাহিদা ও কল্যাণের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, এর মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষা প্রকল্পটি এবং একটি বাড়ি খামার প্রকল্পটি দারিদ্র পিড়ীত এবং দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি। এই দশ প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ প্রবণ এলাকাগুলিতে নেওয়া পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী নিজে সার্বক্ষণিক তদারকি ও পর্যালোচনা করছেন। তা ছাড়া সকল প্রকল্পের উপর বর্তমানে এই দশটি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচারিত হচ্ছে।
এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে ঃ

১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হওয়ায় বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং সকল গৃহহীন পরিবারসমূহকে পুনর্বাসনের তাৎক্ষনিক নির্দেশ দেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রায়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিন পর্যায়ে আশ্রায়ণ প্রকল্পে  ১,৯০৪.১০ কোটি টাকা ব্যয় করে মোট ১,৪৩,২২৩টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সাফল্য ও ধারাবাহিকতায় ২০১০-২০১৭ (সংশোধিত) মেয়াদে ৫০,০০০ গৃহহীন, ছিন্নমূল পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার আওতায় সারাদেশে গ্রামাঞ্চলে ব্যারাক হাউজ এবং বিভাগীয় সদর ও রাজউক, বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন এলাকা, জেলা ও উপজেলা সদর এবং পৌরসভা এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আন্তরিক উদ্যোগের কারণেই চলতি বছরের ২৫ মে মেক্সিকোর কানকোনে অনুষ্ঠিত তিনদিনের ‘গ্লোবাল প্লাটফর্ম ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন-২০১৭’ সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দুর্যোগ প্রশমনে দেশের সার্বিক কার্যক্রম এবং ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা ডিক্লারেন্সসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

সম্মেলনে জাপান, ইতালি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা প্রতিবন্ধী সুরক্ষায় বাংলাদেশের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের অনুরোধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অতিরিক্ত পাঁচ মিনিট বক্তব্য রাখেন। এই

সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে প্রণীত বাংলাদেশের ‘ন্যাশনাল প্লান ২০১৬-২০২০’ প্রসংশিত হয়।
দুর্যোগে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ভূয়সী প্রশংসা করেন থাইল্যান্ড, মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রীরা। একই সঙ্গে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় তারা প্রশংসা করেছেন। সর্বপোরী সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ঘটার আগেই গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করছে। ফলে আগামী দিনে দুর্যোগ মোকাবেলায় আরো সাফল্য আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।