আজ পহেলা বৈশাখ মহামারি পেরিয়ে নতুন স্বপ্ন প্রত্যাশায় জাল বুনছে জাতি/

414

॥ আনোয়ার আল হক ॥

আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আবার এলো নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রাণের উৎসব। এই দিনে পূরোনো জীর্ন অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে আমরা সতেজ-সজীব নবীন এক জীবনকে বরণ করে নেই। বছর ঘুরে আমরা পদাপর্ণ করতে যাচ্ছি নতুন বছর ১৪২৯ এ। নতুন বছর আমাদের সকলের জন্য আনন্দ ও মঙ্গল বয়ে আনুক।

করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে গত দু’বছর বাঙালির জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি ছিল একদম সাদামাটা ও পানসে। গত দু’বছর মানুষ ঘরে আবদ্ধ ছিল, তাই বৈশাখ বরণে মেতে ওঠা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে করোনার প্রকোপ কেটে গিয়ে দেখা মিলেছে সোনালী সূর্যের। এ বছর নতুন প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে। তবে পহেলা বৈশাখে রোজা পড়ে যাওয়ায় অনুষ্ঠানমালায় বেশ কাটছাট করেছে আয়োজকরা। কিন্তু বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য (জাতিসংঘ স্বীকৃত) মঙ্গল শ্যোভাযাত্রা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে। রাজধানীতে ছায়ানটের আয়োজনে যেমন শোভাযাত্রা হবে, তেমনি জেলাগুলোতেও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে নব-বর্ষের অনুষ্ঠানমালা। রাঙামাটিতেও দিনটি ঘিরে শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জেলাপ্রশাসন।

মহাকালের রথ তার যাত্রাপথে পেরিয়ে গেল বাংলা ১৪২৮ সনের সীমানা। নিয়ত উদয়াস্তের খেলায় সূর্য যখন পূর্ব দিগন্তে লালিমা ছড়িয়ে নিজেকে জানান দিয়েছে তখন দুয়ারে নয়া বছর। বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই ১৪২৮ বঙ্গাব্দ হয়েছে অতীত। আজ বৃহস্পতিবার পহেলা বৈশাখ। পঞ্জিকার শাসনে মাসের নামটি অপরিবর্তনীয় থাকলেও এসেছে বাংলা নববর্ষ। খোশ আমদেদ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।

পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কুপমুন্ডকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।

পুরনো জীর্ণ, হতাশা-ব্যর্থতা, তথা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের তাবৎ অমানিশা উতরে সহজাত সুন্দরের প্রয়াস সবার। করোনার অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পার করে নতুন দিন, নতুন বছরের সাথে নতুন স্বপ্ন-প্রত্যাশায় জাল বুনছে জাতি। মহামারি কেটে মঙ্গলের বার্তার প্রতীক্ষা সকলের। সকল আঁধার কেটে যাক, আসুক আলো, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি টুটে যাক বৈশাখের উৎসব মুখরতায়। গণপ্রার্থনা পেয়েছে কাব্যরূপও- “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নি ¯œানে শুচি হোক ধরা।” সত্য-সুন্দরের সম্ভাবনায় শুরু হোক নতুন বছর, নতুন দিন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ জাতীয় ছুটির দিন। হাঁস-ফাঁস করা গরমের মধ্যেও গত দু’দিন পাহাড় জুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ, আর বর্ষবরণে বর্ণাঢ্য আয়োজনের ঘনঘটা। গতকাল মুল বিজুর দিন পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘরে ছিল সর্বস্তরের জনতার ভিড়।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। এ উপলক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
আসলে কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। আজ ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্বপ্ন, করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন বিশ্ব নতুন বালাদেশ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঙালিরা করোনা মহামারী থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই নতুন বছরকে বরণ করে নেবে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানমালায়।

এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।

মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সাথে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তন শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। নতুন বছরটি আমাদের জীবনে বয়ে আনুক সুখ-শান্তি, সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি।