আর কত লাশ বহন করবে নিষ্ঠুর পাহাড়

493

শামীমুল আহসান- ঢাকা ব্যুরো প্রধান, আল-মামুন- খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, ২০ আগস্ট ২০১৮, দৈনিক রাঙামাটি:  পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ও রাঙামাটিতে চাঁদাবাজি এবং অপহরণ বানিজ্যকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ, জেএসএস সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ- এর মধ্যে ত্রিমূখী ভ্রাত্রিঘাতি লড়াইয়ে সাম্প্রতীক সময়ে (গত ৪/৫ বছরের মধ্যে) প্রায় শতাদিক পাহাড়ি উপজাতি নিহত হয়েছে। এ বছরের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হিল উইমেন ফেডারেশনের মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমার অপহরণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায় পৌঁছায়। মন্টি ও দয়াসোনা উদ্ধারের পর এর জের ধরে ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-সংস্কার) নেতা শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর একের পর এক সংঘাতে অনেকে প্রাণ দিতে হয়। এর জেরে সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট শনিবার আরো সাতজনকে প্রাণ দিতে হলো। সাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ভ্রাত্রিঘাতে আর কতো লাশ বহন করতে হবে সবুজে ঘেরা নিষ্ঠুর পাহাড়কে ?

প্রতিবাদে সোমবার আধাবেলা সড়ক অবরোধ

শনিবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে পূর্ব নির্ধারিত বিক্ষোভ ও সামাবেশে গণজমায়েতের প্রতিকালে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর বাজাওে দুই দফায় প্রতিপক্ষের প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ারে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাসহ সাতজন নিহত হয়। হত্যাকান্ডের ঘটনায় ঘাতকরা সয়ংক্রিয় এসএমজির প্রায় ৫০/৭০ রাউন্ড তাজা বুলেট ব্যবহার করে বলে জানা যায়। এ ঘটনায় এখনো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। থমথমে পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে স্বানির্ভর এলাকার বেশির ভাগ দোন-পাঠ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ জেএসএস সংস্কারকে দায়ী করলেও প্রতিপক্ষটি সে দায় অস্বীকার করেছে।
খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর ও পেরাছড়ায় ইউপিডিএফ ভুক্ত অংগ সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জেএসএস সংস্কারবাদী নব্যমুখোশ বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন খাগড়াছড়ি জেলা শাখা আগামী ২০ আগস্ট ২০১৮, সোমবার আধাবেলা খাগড়াছড়ি জেলায় শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধ পালন করবে। অবরোধের সময় এম্বুলেন্স, রোগী বহনকারী যান, ফায়ার সার্ভিস, জরুরী বিদ্যুৎ, পানি ও ওষধ সরবরাহকারী গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে। পিসিপির খাগড়াছড়ি জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক সমর চাকমা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিষয়টি নিশ্চিত করেন।


এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি বলে জানান, খাগড়াছড়ি সদর থানার (ওসি) অফিসার ইনচার্জ মো: শাহাদাত হোসেন টিটো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ শহওে সেনা ও বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। এদিকে হত্যাকান্ডের পর দুপুর ১২টার দিকে ইউপিডিএফ এর সমর্থক রা জেলা সদরের ধর্মপুর এলাকায় একটি মিছিল বের করতে চাইলে প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রিক)এর অস্ত্রধারীরা মিছিলের উপর গুলিবর্ষন করলে স্বনির্ভরের ঘটনা সহ মোট ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়।
ধর্মীয় নানা আনুষ্ঠানিকতার সেড়ে খবংপুড়িয়া শশ্মানে রবিবার দুপুরে গুলিতে নিহতদের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা রুপক চাকমা ও মহালছড়ির স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমাকে অশ্রæসিক্ত বিদায় জানান স্থানীয়রা। ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে অনুষ্ঠানের পর তাদের দাহ সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপির খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহসাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সহসভাপতি পলাশ চাকমার লাশ ময়না তদন্ত শেষে নিহতদের হস্তান্তরের পর থানায় রাখা হয়েছে। তবে দাহক্রিয়ার সকল প্রস্তুতি চলছে বলে জানান ইউপিডিএফ- সংগঠক ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা।
ব্রাশফায়ারে নিহত বরুণ চাকমা ও মিছিলে ব্রাশফায়ার কালে পড়ে গিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত ছন কুমার চাকমার লাশ তাদের স্বজনরা নিয়ে যায়।

কে করবে আমার বাবা হত্যার বিচার ?


আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। তাদের একজন মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্রের স্বাস্থ্য সহকারী জীতায়ন চাকমা।
শনিবার ১৮ আগস্ট, সকালে বাড়ির পাশেই স্বনির্ভর বাজারে নাস্তা করতে যান জীতায়ন চাকমা। নাস্তা করতে এসে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি সেখানেই প্রাণ হারান । তার অনাকাংখিত মৃত্যুতে পুরো স্বনির্ভর এলাকায় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীদের বুলেট শুধুমাত্র জীতায়ন চাকমার জীবনই কেড়ে নেয়নি। একইসঙ্গে অভিভাবকহীন হয়েছে তার পরিবার।
স্ত্রী আর তিন কন্যাসন্তানের হাসিখুশির সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জীতায়ন চাকমা। বড় মেয়ে জুলি চাকমা ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করেছেন। মেজ মেয়ে পলি চাকমা খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে অন্বেষা চাকমা খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
কে করবে আমার বাবা হত্যার বিচার ? ‘আমার নিরপরাধ বাবাকে কেন খুন করা হলো ? আমাদের দায়িত্ব কে নেবে ? আমার ছোট দুই বোনের লেখাপড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে ? কিভাবে চলবে আমাদের পরিবার ?’ কান্না করতে করতে এভাবেই প্রশ্নগুলো ছুড়লেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী জীতায়ন চাকমার বড় মেয়ে জুলি চাকমা। একইসঙ্গে তাদের পরিবারের নিরাপত্তা এবং বোনদে লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার জন্য একটি সরকারি চাকরি চেয়েছেন জুলি চাকমা। রোববার সকালে নিহত জীতায়ন চাকমার বাড়িতে গেলে এসব কথা বলেন তার মেয়ে জুলি চাকমা। পাশেই অঝোরে কাঁদছিল ছোট বোন অন্বেষা চকমা। বাবার মরদেহের পাশে চুপচাপ বসেছিল পলি চাকমা। তার চোখে-মুখে বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি। এক পর্যায় হত্যা জজ্ঞে জড়িত সন্ত্রাসীদের শাস্তির দাবী করে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহত জিতায়নের তিন মেয়ে।
জীতায়ন চাকমার স্ত্রী প্রভাতি চাকমা বলেন, সকালে নাস্তা করতে বের হয়ে মানুষটা আর ফিরবে না তা কি জানতাম। যদি এমন হবে জানতাম তাহলে তাকে বাসা থেকে বের হতে দিতাম না।
স্বামীর আয়ে সংসার চলে জানিয়ে প্রভাতি বলেন, তিন মেয়েই পড়াশোনা করছে। এখন কীভাবে আমার সংসার চলবে। কিভাবে মেয়েরা পড়বে ? কেন নিরপরাধ মানুষটাকে মরতে হলো। কার কাছে বিচার চাইব ?

বিয়ের পিড়িতে বসলো না ধীরাজ


টেক্সটাইল প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমা। এ ঈদের বন্ধেই তার বিয়ে হওয়ার কথা। পাত্রী ঠিক ছিল। কিন্তু পরিবারের সে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীদের বুলেট। কথাগুলো বিলাপ করে বলছিল ধীরাজ চাকমার মা ফুল কুমারী চাকমা।
ধীরাজ চাকমার বাড়ী পানছড়ির উগলছড়িতে। কর্মস্থল ছিল কুষ্টিয়ায়। শুক্রবার রাতে নৈশকোচে করে ঢাকা হয়ে বাড়ী ফিরছিলেন। দীর্ঘ দিন পর বাড়ী ফিরছে তাই মায়ের জন্য একটি মোবাইল ফোন সেট ও মিষ্টি কিনেছেন ধীরাজ চাকমা। ভোর পৌনে ৭টার দিকে মাটিরাঙা পৌছে মায়ের সাথে কথা হয়েছে। মাকে বলেছিল, বাসা পৌছে নাস্তা করবে। হয়তো আর ঘন্টা খানিকের মধ্যেই মায়ের পৌঁছে যেত। কিন্তু না, তাঁজা শরীরে তার আর বাড়ি ফেড়া হলো না। ধীরাজ পরের দিন ফিরলেন লাশ হয়ে। সাথে কষ্টের স্মৃতি হয়ে রইলো মোবাইল ফোন সেটটি।

 

পোস্ট করেন- শামীমুল আহসান, ঢাকা ব্যুরো প্রধান।