॥ আলমগীর মানিক ॥
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেছেন, তিন পার্বত্য জেলায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব এলাকায় ইতিপূর্বে কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি সেসব এলাকায় স্থানীয় জনমানুষের চাহিদা ভিত্তিতে বাস্তবমুখী প্রকল্প নেয়া হবে এবং তিন পার্বত্য জেলায় যেখানে উন্নয়নের ছোয়াঁ পৌছায়নি এ বিষয়ে কোন পত্রিকায় কিংবা সামাজিক সোস্যিয়াল মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে সেটাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অত্যন্ত গুরুত্বসহ আমলে নেয়। প্রকল্প/স্কিম নেয়ার জন্য কষ্ট করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে এসে আবেদন না করলেও আমরা নিজেদের দিক থেকে জনমানুষের চাহিদা বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পত্রিকার প্রিন্ট/ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকর্মীকে জনকল্যাণের স্বার্থে বিশেষ ভূমিকা রাখার আহবান জানান।
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর বুধবার ২৫শে আগষ্ট(২০২১ইং) প্রথমবারের মতো বোর্ড সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা এসব কথা বলেন। বুধবার সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ‘পরিচালনা বোর্ড’ এর ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের ১ম সভা রাঙামাটিস্থ প্রধান কার্যালয়ের বোর্ড সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা।
সভার আলোচ্য বিষয় ছিল (১) গত ১৩/০৬/২০২১খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভার কার্যবিবরণী পাঠ ও অনুমোদন এবং গৃহীত সিদ্ধান্তরে অগ্রগতি পর্যালোচনা (২) ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের জুলাই, ২০২১ পর্যন্ত সময়ের অগ্রগতি পর্যালোচনা (৩) ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহায়তা কোড নং ২২১০০১১০০ ও ২২১০০০৯০০-এর প্রকল্প বাছাই ও অনুমোদন (৪) পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তহবিল সংক্রান্ত প্রস্তাবিত বাজেট ২০২১-২০২২ অনুমোদন এবং (৫) বিবিধ।
এসময় বোর্ড চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা) নিখিল কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের “পরিচালনা বোর্ড” এর ২০২১-২০২২ অর্থবছরে অনুষ্ঠিত ১ম সভা। তিনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে পার্বত্য চট্টগাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীগণ ও বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকগণসহ উপস্থিত সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
সভাপতির অনুমতিক্রমে সদস্য প্রশাসন মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ (উপসচিব) বিগত পরিচালনা বোর্ড সভার কার্যবিবরণী পাঠ করেন এবং গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিস্তারিত উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীগণ কোড নং ২২০০১১০০, ২২০০০৯০০ এর আওতাধীন প্রকল্প/স্কিম এবং বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকগণ পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নাধীন জুলাই ২০২১খ্রি. পর্যন্ত সময়ের সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে বিবরণ তুলে ধরেন। এছাড়া বোর্ডের ২০২১-২০২২ অর্থবছরের কোর্ড নং-২২১০০১১০০ এর আওতায় গৃহীত প্রকল্প/স্কিমসমূহের তালিকা অনুমোদন এবং কোড নং-২২১০০০৯০০ এর আওতায় গৃহীত প্রকল্পসমূহের তালিকা যাচাই বাছাই পূর্বক মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রেরণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এছাড়া রিজার্ভ বাজার হতে জুগুলুক্যা পাহাড় ও পুরানবস্তি এবং আসামবস্তি হতে ব্রাক্ষনটিলা সেতুর নামকরণে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ, রাঙামাটি শৈল বিপনী বিতানের বিভিন্ন সমস্যা, ভাড়া ও জামানত বৃদ্ধি এবং চুক্তিনামা নবায়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তহবিল আইন, উঁচুভূমি বন্দোবস্তীকরণ প্রকল্প, ভূমি সম্পত্তি রেকর্ড সংরক্ষণ, তিন পার্বত্য জেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ঘরে ঘরে সোলার বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন, পর্যটন শিল্প বিকাশে দৃষ্টি নন্দন গেইট/বিল বোর্ড স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, শিক্ষা সম্প্রসারণ, কৃষি, পানীয়জল সরবরাহকরণ ও যোগাযোগ সেক্টরকে অগ্রাধিকার প্রদান, তিন পার্বত্য জেলায় হেডম্যান কার্যালয় নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, স্থানীয় জনমানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জুম চাষের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায়ন ব্যবস্থাকরণসহ তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক রাস্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিহারের বিয়য়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
ভাইস চেয়ারম্যান আশীষ কুমার বড়ুয়া বলেন, জুম চাষ এ অঞ্চলের মানুষের আদি জীবিকার অন্যতম প্রধান পেশা। পাহাড়ে বসবাসকারী এবং নিরাপত্তকর্মীদের মশা মাছি উপদ্রপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জুমের মৌসুমে আগুন দিয়ে জুম পুরানো অত্যন্ত সহায়ক। এতে পাহাড় জঙ্গল পরিষ্কার থাকে এবং পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষ ম্যালেরিয়া প্রকোপ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাচ্ছে। তবে জুম চাষের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় ফসল কম উৎপাদন হয় বিধায় তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য জুম চাষের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষ জুমের উপর নির্ভরশীল। ফলজ বাগান থেকে ফল আসতে কমপক্ষে ৫-৬ বছর সময়ের প্রয়োজন। জুম চাষ বন্ধু করা যাবে না। জুম চাষের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকায়ন ব্যবস্থা করতে হবে মর্মে সভায় মতামত প্রকাশ করেন।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ^াস বলেন, শিক্ষা, যোগাযোগ ও পানীয়জল সরবরাহকরণ প্রকল্পকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। এখানকার প্রান্তিক মানুষকে যদি আমি পড়াতে না পারি তাহলে এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষ কিভাবে শিক্ষিত হবে। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে গোসল করার পানি পাওয়া যায় না। খাবার পানি পাবে কোথা থেকে। শুস্ক মৌসুমে এ বিষয়টি বেশি লক্ষণীয়। তিনি আরও বৃষ্টির পানি রক্ষণের জন্য যেখানে জনবসতি আছে সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা দরকার যাতে স্থানীয় লোকজন ব্যবহার করতে পারে। সেজন্য পানীয়জল সরবরাহ প্রকল্পকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া দরকার মর্মে মতামত প্রকাশ করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক জনাব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, দুর্গম এলাকার ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার জন্য হোস্টেল নির্মাণে বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা বাস্তবায়নে লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্গম এলাকায় হোস্টেল নির্মাণ/সংস্কার করা দরকার মর্মে সভায় মতামত তুলে ধরেন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক জনাব ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, মিশ্র ফলজ বাগান হতে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফল বাজারজাতকরণ করা দরকার যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কৃষক সহজে বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্য মূল্য পায়। এতে স্থানীয় কৃষকরা বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও অধিক উৎসাহিত হবে এবং উপকৃত হবে। পাহাড়ে রাস্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিহারে বিভিন্ন আইনগত বিষয়ে জটিলতা নিরসনে সহযোগিতা করার কথা ব্যক্ত করেন।
বোর্ড সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান সরকারের যুগ্মসচিব আশীষ কুমার বড়ুয়া, সদস্য প্রশাসন উপসচিব মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক জনাব প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি,পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপসচিব উদয়ন দেওয়ান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলার পল্ল¬ী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ আবদুল আজিজ, খাগড়াছড়ি ইউনিট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মুজিবুল আলম, মংছেনলাইন রাখাইন, উপপরিচালক, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড; বান্দরবান ইউনিট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাত, মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম, সিএমইউ জেনারেল ম্যানেজার পিন্টু চাকমা, কল্যাময় চাকমা, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা; তুষিত চাকমা, রাঙামাটি নির্বাহী প্রকৌশলী (চ:দা); কাইংওয়াই ম্রো, গবেষণা কর্মকর্তা; সাগর পাল, সহকারী পরিচালক (চ:দা) উপস্থিত ছিলেন।