মাহে রমযান মুসলিম উম্মাহর জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত

412

॥ আনোয়ার আল হক ॥

আমরা সৌভাগ্যবান বলেই আবারও পার করার সুযোগ পাচ্ছি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারক। হিজরী বা চন্দ্র বর্ষের নবম এই মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য অফুরন্ত কল্যাণ ও আল্লাহর অশেষ মেহেরবানির বার্তা নিয়ে আগমন করে। ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদী বিষয়ের অন্যতম সিয়াম সাধনা এ মাসের সাথে জড়িত। প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার থেকে সংযত থাকা এ মাসে মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় ইবাদত। কুরআন মজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে হে মুমিনরা, তোমাদের আগের উম্মতদের ওপর যেমন রোজা ফরজ করা হয়েছিল তেমনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করা হলো সিয়াম, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)।

মাহে রমযান মুসলিম উম্মাহর জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এই মাসে সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি, আলাহর নৈকট্য লাভ, রহমত ও বরকত অর্জনের চেষ্টা করা প্রতিটি বিবেকবান মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, রোজা পালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি যে ভয় ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সে জন্য বান্দাকে তিনি নিজ হাতে পুরস্কৃত করবেন। হাদিস শরীফে রয়েছে, রোজাদার ব্যক্তিদের বেহেশতে প্রবেশের জন্য ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা সংরক্ষিত থাকবে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বছরে রমজান মাসের সিয়াম সাধনার হুকুম নিয়ে আয়াত নাজিল হয়। আগেও আল্লাহর নবী সা: ও সাহাবায়ে কেরাম ইবাদতটি করতেন। তবে তা রমজান মাসের সাথে যেমন নির্দিষ্ট ছিল না তেমনি মাসব্যাপীও ছিল না। প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করা হজরত আদম আলায়হিস সালাম থেকে শুরু করে অনেক নবীর শরিয়তে ছিল বলে জানা যায়। আমাদের নবী সা: যথারীতি তাই পালন করতেন বলে সাহাবিরা বর্ণনা করেছেন। তেমনি মহররম মাসের দশম দিন বা আশুরার তারিখে রাসুল (সা:) ও সাহাবিরা আগে থেকেই রোজা রাখতেন। এটাকে অপরিহার্যভাবে পালন করা হতো। রমজানের রোজার নির্দেশ আসার পর আশুরার রোজা অপরিহার্য রইল না। অবশ্য গুরুত্ব ও ফজিলত বহাল রয়েছে আগের মতোই।

রমজানের দিনের বেলা সিয়াম পালন এখন অপরিহার্য কর্তব্য। সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ সংযম। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে আত্মসংবরণ করাই শরিয়তে সিয়াম হিসেবে আখ্যায়িত। এ জন্য প্রধান যে সুফল অর্জিত হয়, কুরআন মজিদের ভাষায় তার নাম তাকওয়া। আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হয়েছে তাকওয়াকে। সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “হে মানুষেরা, আমি তোমাদেরকে একজন নর ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে পরিণত করেছি তোমাদের পরস্পরের পরিচিতির জন্য। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকি ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত”। সুতরাং রমজানের সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার কাছে মর্যাদা লাভের যোগ্যতা অর্জিত হয়।

আত্মশুদ্ধি, সাম্য, সহমর্মিতা ও মানবীয় গুণাবলীর সৃষ্টির উদাত্ত আহবান নিয়েই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমযান। মুসলিম সমাজের জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মাস পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাস, কওমের বিজয়ের মাস। মুসলমানের দ্বীন ও দুনিয়ার সমৃদ্ধি, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, দৈহিক ও মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব আর গৌরব ও মর্যাদার অবিস্মরণীয় স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে রমজান। উন্নত চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায় পাশবিক বাসনার প্রাবল্যকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই হচ্ছে সিয়ামের তাৎপর্য। ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে সর্বত্র আলাহর দীনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় প্রতিকূলতার মুখে টিকে থাকার জন্য যে মনমানসিকতার প্রয়োজন, সিয়াম সাধনার দ্বারা তাই অর্জিত হওয়ার কথা। মানবতার মহান নেতা রাসূলুলাহ (সা.) ও তার বিপ্লবী সাহাবারা এ মহান মাসে লড়াই করেছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে, অন্যায়, অসত্য, জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে এবং মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব খতম করার মহান লক্ষ্যে।

এ মাসের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। রমজানের পরিবেশ বজায় রাখার জন্য প্রশাসনকেও আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নাগালের রাখার জন্য যেমন সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তেমনি গরীব, অসহায় ও মেহনতি মানুষ যেন অর্ধাহারে ও অনাহারে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই মাসের সম্মানে শ্রমিকদের শ্রম কমিয়ে দিয়ে পুরাপুরি মজুরি প্রদান করা সকলের কর্তব্য। পবিত্র রমজান উপলক্ষে সকলকে দ্বন্দ¡-কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা ও চোগলখোরী ছেড়ে দিয়ে আত্মসংযম অর্জন করতে হবে। এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল, কুরআন হাদিস, ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন এবং মাসের পবিত্রতা রক্ষা করে যাবতীয় বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে। রমজানের প্রতিটি দিন যথানিয়মে অতিক্রম করাসহ সিয়াম পালনে যতœবান থাকতে হবে, যাতে সত্যিকারের তাকওয়া অর্জিত হয় এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সে তৌফিক দিন, আমীন।