নতুন সাজে সজ্জিত প্রকৃতির রাণী রাঙামাটির পর্যটন স্পটগুলো এখন দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত

632

॥ ইকবাল হোসেন ॥
নতুন সাজে সজ্জিত প্রকৃতির রাণী রাঙামাটির পর্যটন স্পটগুলো এখন দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি ঘেরা রাঙামাটির মোহনীয় সৌন্দর্য সাধারণত শীতল আবহাওয়ায় আরো মূর্ত হয়ে উঠে। মাঝে কয়েকদিন শীতের প্রকোপ কিছুটা বাড়তির দিকে থাকলেও হীমেল ভাব কমতে থাকায় পর্যটকরা দল বেঁধে ছুটে আসছেন প্রকৃতির কাছে। তাদের বক্তব্য, এটাই বেড়ানোর মোক্ষম সময়। রাঙামাটির হোটেল মোটেলগুলো এখন পরিপূর্ণ; পর্যটকদের বাড়তি অনুসঙ্গ হিসেবে যোগ হয়েছে পাহাড়ের রসালো কমলাসহ স্থানীয় নানা ফল।

করোনার প্রভাবে মাঝখানে অন্ততঃ চারমাস পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল প্রশাসন। এই অবকাশে সবগুলো পর্যটন স্পট নতুন করে সাজিয়েছে কর্তৃপক্ষগুলো। নবসাজে সজ্জিত ঝকঝকে পর্যটন স্পটগুলোতে ঘুরে দারুনভাবে আনন্দিত পর্যটকরাও। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় পারিবারিক ট্যুরের ধুম পড়েছে।

বেড়াতে আসা নানা বয়সি পর্যটকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তাদের অনুভ’তি পাওয়া গেলো যে, ‘সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও মানুষ প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে একটুখানি প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায়। কিছুক্ষণের জন্য কাজের কথা ভুলে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চায়। তা ছাড়া যন্ত্রদানবের মতো সারাক্ষণ কাজ করাটা বিজ্ঞান সম্মতও নয়। নিজের যেমন রিলাক্স প্রয়োজন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে একটু ঘুরে আসা; তাদের জন্য কিছুটা সময় একান্তভাবে ব্যয় করা সুখী সংসারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে  প্রকৃতির রাণী রাঙামাটিই তাদের কাছে আদর্শ স্থান। হ্রদ পাহাড় ঘেরা রাঙামাটিতে প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ, পাখির কলকাকলী এবং সাগর বেলার পরিবেশ একসাথে বিদ্যমান। ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্ক’ এর কাঠের তাকিয়াগুলোতে শুয়ে বা হেলান দিয়ে ছবি তুললে মনে হয় আপনি কোনো সমুদ্র সৈকতে ছবি তুলেছেন। চাইলে সাধারণ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা স্পীড বোটে করে খানিকটা ঘুরেও আসা যায়। এতে বাড়তি এক প্রাকৃতিক অনভূতি পাচ্ছেন পর্যটকরা।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ লীলা নিকেতন পার্বত্য রাঙামাটি। লীলাময়ী প্রকৃতি যেন আপন হাতে সাজিয়েছেন এর রূপ মাধুরী। সবুজ চাদর পরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চল পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশে কুল কুল নাদে বয়ে চলা প্রাকৃতিক ছড়া, সর্পিল এঁকে বেঁকে দূর পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া মেঠোপথ, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার স্বচ্ছ জল, কর্ণফুলীর স্রোত, কাপ্তাই হ্রদের শান্তজলে স্রোতহীন ছোট ছোট ঢেউ।

পাহাড়ের কঠিন বুকে ঘাম ঝরিয়ে গড়ে তোলা গ্রাম্য নারীর স্বাদের জুম। জুম ক্ষেত্রের বিচিত্র সব্জি বাগান, আর রবিশস্যে সোনালী দোল। ফাঁকে ফাঁকে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ও সৃজিত বন বাগান। বুনো ফুলের মন মাতানো সৌরভ, অতিথি পাখির কিচির-মিচির ডাক, বানর ডাহুক আর হরিণের দুর্লভ মিতালী এমন বর্ণনাতীত বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পার্বত্য রাঙামাটি। তাইতো কবি সাহিত্যকরা আদর করে এর নাম রেখেছে প্রকৃতির রাণী।

দেশ বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত হাজারো প্রকৃতি প্রেমি এই সবুজাভ বৃষ্টিস্নাত পাহাড় আর পাহাড় সন্নিহিত অর্বাচিন রূপমাধুরী অবলোকন করতে ছুটে আসছেন এক অমোঘ সুতোর টানে। আবহমান বাংলার সর্বাঙ্গজুড়েই সবুজের সমারোহ সারা বিশ্বে এক আলোচিত অনুসঙ্গ, তার মাঝেই পার্বত্য রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলা যেন প্রস্ফুটিত রংধনু। যারা এর সৌন্দর্য সুধা পান করে একবার চমৎকৃত হয়েছেন, তিনি বার বার ছুটে আসতে বাধ্য হন এই প্রকৃতির কোলে। ছবির মতো সবুজে ঘেরা পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদের বিশাল স্থির নীল পানি রাশি রাঙামাটিকে বাংলার সৌন্দর্য্যরে স্বর্গে পরিণত করেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অপার আঁধার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। তাই পার্বত্য শহর রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম।

রাঙামাটিতে সম্প্রতি চালু করা হয়েছে, ওয়াটার বাস এটা পর্যটকদের কাছে বাসড়ি আকর্ষণ। এদিকে সেনাবাহিনী পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা আরণ্যক কেন্দ্রের ওয়াটার পার্ক এ একবার যে অবগাহন করেছে, তার হৃদয় মুকুরে এই স্মৃতি বারবার আবর্তিত হয়।

এখন রাঙামাটি শহরে পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় পাহাড়িদের পরম যত্নে চাষ করা বড়বড় রসালো কমলা। দাম কিছুটা চড়া হলেও কমলা বাজার ওঠার সাথে সাথেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ি মাল্টা, মিষ্টি পেয়ার, আনারস এবং টপটপা আমলকি। পাহাড়ি নারীদের হাতে বোনা বস্ত্র সম্ভার তো আছেই। এই বস্ত্র সম্ভারে যুক্ত হয়েছে শীতকালীন নানা পোষাক।

বর্তমান সময়ের গতিময় জীবন প্রবাহে কাজের অবসরে যারা প্রতিনিয়ত খুঁজে ফেরেন রোমাঞ্চকর এমন কোনো স্থান যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গে ঘেরা সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশে মেঘের  মিতালি! তাদের মন থেকে রাঙামাটি কখনই মুছে যায় না। সবুজ-শ্যামল চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এই অপরূপ রাঙামাটিতে যাদের আসার সুযোগ হয়নি, তারা হয়তো বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্য কখনই চিত্রিত করতে পারবেন না। লীলাময়ী প্রকৃতি যেন আপন হাতে এ অঞ্চলে তার সৌন্দর্য সুধা ঢেলে দিয়েছেন। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত বনরাজির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভাবুক মন খেই হারিয়ে ফেলে- ‘সবুজের কত রং হতে পারে’। হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ, ফিকে সবুজ, শ্যামল সবুজ.. এভাবে নামকরণ করতে বলা হলে হয়তো কারো পক্ষেই এই সবুজের বিশেষণ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। সবুজের শেষ প্রান্তে মেঘ বালিকার মিতালি, উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, আর তুলির আঁচড়ের মতো মাঝে মাঝে সবুজের বুক চিরে বয়ে যাওয়া কাচালং নদী আর পাহাড়ি ছড়া, যে কোনো নিরস মনকেও ভাবুক আর উদাস বানিয়ে দেয়; কিছুক্ষণের জন্য হলেও। নগর জীবনের আয়েসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত আক্ষরিক অর্থে সভ্য মানুষ এই রূপ ভুলতেই পারেন না। এই শহরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সাপছড়ির ফুরোমোন পাহাড়, আর শেষ প্রান্তে ডিসি বাংলো।

সেই রাঙামাটির একটি শান্ত ছায়া সুনিবিড় এলাকার নাম ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্ক’। গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি সব যেমন আছে। তেমনি আছে শিশুদের বিনোদনের জন্য দোলনা, স্লীপার; আছে বানরের খেলা। যতœময় হাতের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠানো সাজানো ফুলবাগান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বুনো ফুলের সমাহার। পাহাড়ের উঁচু টিলায় বসে দীগন্ত বিস্তৃত হ্রদের সৌন্দর্য দেখতে চাইলে আপনাকে এই জায়গাটিই বেছে নিতে হবে। বেড়াতে বেড়াতে খানিকটা গলা ভিজিয়ে নেওয়া বা কিছু চিবানোর ইচ্ছা থাকলে তাও পুরণ করে নিতে পারবেন অনায়াসেই। এখানে ছোটখাট রেস্টুরেন্ট, কুলিং কর্ণার এবং ছোট্ট একটি দোকানও রয়েছে। জেলা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্কটি যে কোনো বয়সের নারী পুরুষ কিংবা শিশুদের বেড়াবার জন্য একটি আদর্শ স্থান। সবদিক তেকে নিরাপদও বটে। এই স্থানটির সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য দিক হলো সমুদ্র সৈকতের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ। এখানে আপনি নিশ্চিন্তে হৃদের জলে পা ভিজিয়ে নিতে পারবেন। ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্ক’ এর পাশেই আছে লাভস্পট। এটি একটি সিম্বল মাত্র। বিশ্বের অনেক দেশেই পর্যটন এরাকগুলোতে ভালোবাসার নিদর্শন প্রকাশ করার জন্য এমনি লাভস্পট চিহ্নিত করা আছে। এই পার্কে প্রবেশের জন্য অবশ্য বর্তমানে টিকেট কাটতে হয়। জনপ্রতি ১৫ টাকা। এই হার কমানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে।

যারা ভিন্ন জেলা বা ভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক হিসেবে রাঙামাটি বেড়াতে আসেন, তাদের জন্য তো বটেই এই শহর বা আশেপাশের অধিবাসীদের জন্য এই ‘পলওয়েল ন্যাচারাল পার্ক’ স্পটটি বেড়ানোর একটি অনন্য এবং অনবদ্য স্থান। কাজের ফাঁকে বা ছটির দিনে এখানে নিজে বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে বিকালটা কাটিয়ে এলে দেখবেন আপনার দেমাগ অনেক প্রসন্ন হবে।

বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রকৃতির রাণী রাঙামাটিতে ভ্রমণ করার জন্য রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে সুখী নীলগঞ্জ এবং ফুরমোন অনতম আকর্ষণীয়। এ ছাড়া কাপ্তাই হ্রদ, পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক, পেদা টিংটিং, সুবলং ঝর্ণা, রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।