৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য সীমান্তে ৩১৭ কি.মি সড়ক নির্মান কাজ শেষ পর্যায়ে

92

॥ আনোয়ার আল হক ॥

পাহাড়ের বুক চিরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন; একদিন যা স্বপ্ন ছিল আজ তা মূর্ত হয়ে উঠছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নিরলস পরিশ্রম আর অসীম সাহসিকতায়। নয়নাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত জুড়ে সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে কালো পিছঢালা এই সড়ক দিনে দিনে মূর্ত হয়ে উঠছে। খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার সব অজানা দুয়ার। বান্দরবানের ঘুমধুন থেকে শুরু হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত নির্মাণাধীন এই সড়ক ধরে যে কেউ একবার এগিয়ে গেলে বারবার যেতে মন চাইবে।

রাঙামাটি জেলার জুরাছড়ি সীমান্তবর্তী সাইচল অংশ শুক্রবার পরিদর্শন করেছেন সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলোতে কাজ করা জনা ত্রিশেক সাংবাদিক। সড়কটি দেখে সবাই যেমন মুগ্ধ, তেমনি অবাক হয়েছেন সকলেই। এমন দুর্গম এলাকা উন্নয়নের ছোঁয়ায় এভাবে বদলে যাবে, তা হয়তো কারো কল্পনাতেও ছিল না। রাজস্থলী থেকে সাইচল পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার সীমান্ত সংযোগ সড়কটি গিয়ে মূল সীমান্ত সড়ক ছুঁয়েছে।

পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ১০৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত ঘিরে এই সড়কের মূল স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পের তালিকার প্রথম দিকে থাকা এই সড়কটি হতে যাচ্ছে দেশের দীর্ঘতম সীমান্ত সড়ক। ইসিবি-২৬ (ইঞ্জনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যটালিয়ন) প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন ৩১৭ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। ৩ হাজার ৮শ’ ৬১ কোটি টাকার মধ্যে ৮৫% কাজ শেষ। বাকিটাও চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে বলে জানালেন প্রকল্প পরিচালক কর্ণেল ভূঁইয়া মোঃ গোলাম কিবরিয়া।

শুক্রবার (৮ মার্চ) রাঙামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী সাইচলে স্থাপিত অস্থায়ী প্রকল্প ক্যাম্পে গিয়ে সড়ক নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী।

যোগাযোগ সচিব এ সময় বলেন, সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আশা করা যায় এই সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হলে পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এক ঝটকায় পরিবর্তন হয়ে যাবে সাধারণ পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রার মান ও কৃষি বিপণন ব্যবস্থা। এ সময় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের প্রধান প্রকৌশলী মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস পিএসসি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান উপস্থিত ছিলেন।
অন্যান্যের মধে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাকির হোসেন, অতিরিক্ত সচিব এ কে এম শামীম আক্তার, কার্যক্রম বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) খন্দকার আহসান হোসেন, আইএমইডি’র মহাপরিচালক, মো জহির রায়হান, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্মসচিব গৌতম চন্দ্র পাল, অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব ড. আবদুর রহিম, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্মসচিব নিখিল কুমার দাস, সওজ চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো, আতাউর রহমান, রাঙামাটি সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোফাজ্জেল হায়দার, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ, ইসিবির ২৬ এর প্রকল্প পরিচালক কর্ণেল ভূঁইয়া মোঃ গোলাম কিবরিয়া ও রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সভাপতি সাখাওযাৎ হোসেন রুবেলসহ সংশ্লীষ্ট কর্মকর্তাগণ এবং গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থি ছিলেন।

ইসিবি জানায়, বাংলাদেশের সবচাইতে দীর্ঘতম এই সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে শুরু হয়ে পানখাছড়ি, উদয়াচল হয়ে বড় করদিয়া পর্যন্ত তিন পর্যায়ে যথাক্রমে, ৫৬ কিমি, ৮০ কিমি ও ৭৪ মিলিয়ে মোট ২১০ এবং রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী-বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি সীমান্তে আরো ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে, বান্দরবানে আরো ৩৩ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ প্রায় শেষের পথে। চলতি জুনের মধ্যে অবশিষ্ট ২৬ কিলোমিটার সড়কের পেভম্যান্ট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রাজস্থলীর চিংখিয়ং নদী পেরিয়ে হলুদিয়া পাড়া, ফারুয়া, গবাছড়ি এবং মিতিঙ্গছড়ি হয়ে সাইচল পর্যন্ত সড়ক পুরোটাই দুর্গম পাহাড়ি পথ। জিগজাক (আঁকাবাকা) নাম ধারণ করা এই সড়কটি দিয়ে ইতোমধ্যেই স্থানীয় পাহাড়িরা তাদের কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে গৃহনির্মাণ সামগ্রী সহজেই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।

মিতিঙ্গাছড়ির পর তনচঙ্গ্যা পাড়ার মানুষ সেখানে নানারকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। চল্লিশোর্ধ জুম্মবি তনচঙ্গ্যা জানালেন, আগে আমাদের গাছে পেপে পেকে পড়ে যেতো। কলা পেকে পঁচে যেতো, বিক্রয় মূল্য না থাকায় আমরা এসব ফলফলাদি আমরা ছুঁয়েও দেখতাম না । সেই কলার ছড়ি এখন ৫ থেকে ছয়শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তারা সকলেই খুশী, চোখে তাদের রঙীণ স্বপ্ন এবং উত্তরণের হাতছানি।

রাঙামাটির রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল সীমান্ত পথ ধরে সড়কটি খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। সংযোগ করা হবে সাজেকের সাথে। আগামী জুনের পরেই সড়কটির ২য় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে বলে জানালেন কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে সড়কের দৈর্ঘ হবে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার।