‘মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন হাজী মহসিন ও ইউসুফ আলী’

367

॥ শাহ আলম ॥
রাঙামাটিতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন, রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: শহিদুজ্জামান মহসিন রোমান’র পিতা হাজী মো: মহসীন ও চাচা ইউসুফ আলী। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে এমন তথ্য জানিয়েছে। এ নিয়ে আরো গবেষণার আহ্বান জানিয়েছে রাঙামাটির এ ঐতিহ্যবাহী পরিবার।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা হয়েও ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করা, সুবক্তা ও সুলেখক এবং বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা এইচ টি ইমাম রচিত “বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১” বইয়ে রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: শহিদুজ্জামান মহসিন রোমান’র পিতা হাজী মো: মহসিন’র মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সদস্যের বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্য পাওয়া যায়।

মুক্তিযোদ্ধা এইচ টি ইমাম রচিত এবং আগামী প্রকাশনা কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১” বইয়ের সূচীপত্রের “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আমার ডায়েরি’’ ২৫৪ পৃষ্ঠা থেকে ২৯৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিশদ বিবরণীর ২৬১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ইউসুফ আলী ও হাজী মো: মহসীন  এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সদস্যের থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে মুক্তিযোদ্ধা এইচ টি ইমাম রচিত বিশদ বিবরণীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাঙামাটির অবদান সম্পর্কে যা উল্লেখ্য করেন তার অংশবিশেষ:‘‘রাঙামাটিতে আওয়ামীলীগ সংগঠন ছিলো অতি দুর্বল। পৌর অধিকর্তা ছিলেন মুসলিমলীগের। স্থানীয় ব্যবসায়িরা দ্বিধাবিভক্ত। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানিদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। চাকমারা প্রকাশ্যে যোগদান করতে চাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাপ্তাই চন্দ্রঘোনার দিকে তাকাতে হয়েছিলো। শিল্প এলাকা এবং বিরাট সংখ্যক শ্রমিকের সমাবেশ। শ্রমিকদের সবাই বাঙালী এবং অত্যান্ত রাজনীতি সচেতন। শক্ত ট্রেড ইউনিয়ন কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে, চন্দ্রঘোনা কাগজ কলে ও বনশিল্প প্রতিষ্ঠানে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর স্বাধীনচেতা মানুষ সবাই। অতএব এটা হলো আমাদের শক্তি ঘাঁটি। এখানে সৈয়দ আবদুস সামাদ বিরাট সহয়তা পেলেন। আমাদের আরেক শক্ত ঘাটি হলো রামগড়।

নোয়াখালীর অধিকাংশ অধিবাসী এবং সচেতন কর্মী। মাঝখানে খাগড়াছড়ি। সবে মহাকুমা সদর দপ্তর সেখানে স্থানাস্তর করা হয়েছে। আমিই দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করেছিলাম। সরকারি নতুন শহর কেবল গড়ে উঠেছে। চারেপাশে পার্বত্য উপজাতির বসবাস। সেখানে সংগঠন করার কিছুই ছিলো না। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। আমরা সকলে যারা সদর রাঙামাটিতে কর্মরত, তাদেরকেই এগিয়ে যেতে হবে। নিতে হবে অগ্রগণ্য ভূমিকা। এই উপলব্ধি থেকে আমরা  একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলাম।

সরকারি কর্মকর্তা, কর্পোরেশন কর্মকর্তা, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবি, আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এদের সকলের সমন্বয়ে ‘‘সংগ্রাম পরিষদ’’ গঠিত হলো। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের তৎকালীন সহকারি প্রকৌশলী মো: তাজুল ইসলাম তার ছোট একটি স্মৃতি কথামূলক লেখায় লিখেছিলেন। সে লেখার অংশ বিশেষ এই গ্রন্থে সংযোজিত হলো (পরিশিষ্ট মুস্মৃ-১ দ্রষ্টব্য)।

ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুজনের কথা আমার বিশেষ মনে পড়ে, একজন ইউসুফ আলী (বর্তমান রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান মহসীন রোমান এর চাচা) ও হাজী মো: মহসীন (চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান মহসীন রোমান’র পিতা)। এরা দু-ভাই। এদের অনেক লঞ্চ ছিলো। এগুলো চলাচল করতো কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন রুটে।  যেমন- মহালছড়ি, মাইনিমুখ, মারিশ্যা, বরকল, কাপ্তাই ইত্যাদি) এই লঞ্চগুলো ইপিআর জওয়ান ও জে.সি.ও -দের বহন করে নিয়ে আসে রাঙামাটিতে। পূর্ব পরিকল্পিত থাকায় ২৬ মার্চ দিনের মধ্যেই প্রায় সবাই চলে আসেন।’’

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হাজী মো: মহসীন তারা ছিলেন চার ভাই। ইউসুফ আলী, হাজী মো: মহসীন, আনিসুর রহমান ও ড. আবদুল রাজ্জাক। জানা যায়, রাঙামাটিতে হাজী মো: মহসীন এর পূর্ব পুরুষ ও বংশধরা ১৯ শতাব্দী থেকে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইউসুফ আলী, ডাঃ আমিনুর রহমান, হাজী মো: মহসীন ও হাজি আব্দুর রাজ্জাক। এ পরিবারটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীতে নানাভাবে সামাজিকভাবে সহযোগিতা করে ভূমিকা রাখেন। বর্তমানরে হাজী মো: মহসিন সন্তানেরাও সমাজে হত-দরিদ্র, গরীব ও অসহায়দের আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে করে যাচ্ছে। এ পরিবারটি দেশের করোনাকালীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হাজী মো: মহসীন ২০০৫ সালে রাঙামাটির নিজ বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন। সহ-ধর্মীনি আনোয়ারা আক্তার (সাবেক কাউন্সিলর) এখনো জীবিত রয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি ৩ পুত্র ও এক কন্যাসহ অনকে আত্মীয় স্বজন রেখে যান। তার মধ্যে মো: মনিরুজ্জামান মহসিন রানা (সাবেক রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য), আসাদুজ্জামান মহসিন (বিশিষ্ট ব্যবসায়ি) ও কন্যা নওরিন লায়লা (গৃহিনী)।

বাংলাদেশে এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাসে নুন্যতম ১০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পান। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি নাতনিরা ৩০ ভাগ কোটা সুবিধা পান। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকুরীজীবী হলে দুই বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন ও রেশনসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা আছে। এসব সুবিধা পেতে অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে চান বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব খাটিয়ে। কিন্তু ইউসুফ আলী ও হাজী মো: মহসীন (চেয়ারম্যান মো: শহিদুজ্জামান মহসীন রোমান’র চাচা ও পিতা) এর বংশধররা কখনো সার্টিফিকেট কিংবা কোন সুবিধার এসবের জন্য কোন প্রকার দাবি করেননি।
তৎকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার এইচটি ইমাম এর নেতৃত্বে রাঙামাটিতে সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের নেতৃত্বে দেশকে শত্রুমুক্ত করাসহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম।

ওই সময় রাঙামাটির মানুষের কাছে এতই গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন সংগ্রামে তারা বক্তব্য দিয়ে সহজেই উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন মানুষকে। এ সংগ্রাম পরিষদ এর নেতৃত্বেই জনতার প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী তেমন হামলা চালাতে পারেনি। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতার বেশিরভাগই একে একে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেও অনেকে পাননি। স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের হিসেবে তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও স্বাধীনতা পদক প্রদান সময়ের দাবি।